বিজ্ঞানভিত্তিক তদন্তে বাংলাদেশ পুলিশের জনবল তৈরির চ্যালেঞ্জ: tutelagebd.com কিভাবে কাজ করে?
তদন্ত মানে যদি হয় সাক্ষ্য-প্রমাণাদি সংগ্রহ করা, তাহলে তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে বিজ্ঞানভিত্তিক তদন্তের প্রেক্ষাপটে সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহে সক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির অনেক সুযোগ আপনার রয়ে গেছে। একুশ শতাব্দীর উপযোগী তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে নিজেকে তৈরি রাখতে হলে, আপনাকে অবশ্যই বুঝতে হবে যে, তদন্ত মানে কতকগুলো ১৬১ ও কয়েকটি ১৬৪-এর বান্ডিল নয়।
তদন্ত মানে সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহ আর সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহের জন্য অপরাধস্থল গুরুত্বপূর্ন উৎস। বলা হয় প্রত্যেক আসামী অপরাধস্থলে তার অপরাধের বিষয়ে কিছু প্রমাণ রেখে যায়। কিন্তু, অপরাধস্থল থেকে সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহে তদন্তকারী কর্মকর্তার পেশাগত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ঘাটতি তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসাবে তার দক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। এখন সিআইডি কিংবা পিবিআই-এর ক্রাইম সিন টিমের সহায়তা নেওয়ার সুযোগ আছে। তবুও তদন্তকারী কর্মকর্তাকে জানতে হয়, ঘটনাস্থল থেকে কি প্রক্রিয়ায়, কি ধরনের বস্তুগত বা ডিজিটাল আলামত তিনি সংগ্রহ করবেন বা করাবেন; কিংবা তিনি কি করলে বা না করলে অপরাধস্থলে সম্ভাব্য বস্তুগত সাক্ষ্য নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
সাক্ষী বা আসামীর সাক্ষাৎকার বা জিজ্ঞাসাবাদ তদন্তের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও আমাদের অধিকাংশ তদন্তকারী কর্মকর্তার জন্যই এ বিষয়ে একাডেমিক বা পেশাগত জ্ঞান বৃদ্ধির বা প্রশিক্ষণ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আসামীকে গ্রেপ্তার, তার দেহ, বাসস্থান কিংবা যানবাহন তল্লাশী করে অপরাধের তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করার দক্ষতা বা প্রশিক্ষণ অনেক পুলিশ অফিসারদেরই পেশাগত উৎকর্ষতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে।
তদন্তে সন্দিগ্ধ আসামীর PCPR যাচাই করতে হয়। এখন ভিলেজ ক্রাইম নোট বুক বা VCNB নেই, মানে ভিসিএসবি রক্ষণাবেক্ষণের চর্চা নেই; আছে ডিজিটাল ভিসিএনবি তথা ক্রাইম ডেটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম বা CDMS ডেটাবেজ। এটা ভাল যে, অনেক তদন্তকারী ও তদারককারী কর্মকর্তাই এখন CDMS-এর বিষয়ে জানেন এবং উল্লেখ্যযোগ্য সংখ্যক কর্মকর্তা তা’ ব্যবহার করতেও জানেন। CDMS-এর অধিকতর উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় আমরা থানার ভিসিএনবি, কোর্টের পরওয়ানা, দৈনন্দিন বিচারাধীন মামলার তালিকা, বিচার মামলার নথি, চুড়ান্ত স্মারক, সাজা পরওয়ানা, বেইল বন্ড রেজিস্টার প্রভৃতি সংযোজনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। CDMS-এ একজন ব্যক্তির রেকর্ড কেবল একবার থাকবে। এ অনন্যতা রক্ষণাবেক্ষণে যত্নশীল হলে সিডিএমএস ব্যবসথাপনায় একটি বড়ো অগ্রগতি নিশ্চিত করা যায়।
আসামী গ্রেপ্তার, ভিকটিম বা মালামাল উদ্ধার, সহযোগী আসামীকে চিহ্নিতকরণ প্রভৃতি নানা কাজে সিডিআর, ব্যাংক একাউন্ট তথ্য, ফেসবুক, ই-মেইল প্রভৃতি থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণকরণ এখন তদন্তের গুরুত্বপূর্ন অংশ বলে চিহ্নিত হয়। সব তদন্তকারী কর্মকর্তাকে অপরাধে গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষক না হলেও চলে, তবে সব তদন্তকারী কর্মকর্তার জন্য প্রতিটি জেলা বা ইউনিটে একটি অপরাধ গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণ সেল থাকা ও এরূপ গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণ সেল সহায়তা গ্রহণের জন্য সব তদন্তকারী কর্মকর্তারই এ বিষয়ে প্রাথমিক সচেতনতা বা জ্ঞান থাকাটা অত্যন্ত জরুরী। উল্লেখ্য, পুলিশ আদেশ ১/২০২৪-এ প্রতিটি জেলা বা ইউনিটে একটি অপরাধ গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণ সেল থাকা নিশ্চিত করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
মাদক পাচার, মানব পাচার, চোরাচালানসহ বিভিন্ন সংঘবদ্ধ অপরাধের তদন্তে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে বিচিত্র সমস্যায় পড়তে হয়। সংঘবদ্ধ অপরাধে মূল হোতাকে সাধারনভাবে ‘দেখা’ যায় না। আবার, মূল হোতাকে আইনের আওতায় না এনে শুধু মাঠ পর্যায়ে সক্রিয় অপরাধী তথা ফিল্ড অপারেটিবকে ধরে সংঘবদ্ধ অপরাধ দমনে কার্যকর ভূমিকা রাখা যায় না। উদাহরণস্বরূপ, জাল টাকার মামলায় পরিকল্পনাকারী, ব্যবসার মালিক, টাকা প্রস্তুতকারক বিশেষজ্ঞ, সরবরাহকারী, পরিবেশক প্রভৃতি কাউকে অভিযুক্ত না করে কেবল জাল টাকা বহনকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল কিংবা একটি মাদক পাচার মামলার তদন্তে ফেনসিডিলের খুচরো বিক্রেতার বিরুদ্ধে মামলা করে এর পরিবেশক, স্থানীয় গডফাদার বা আশ্রয়দাতা, অর্থযোগানদাতা, সহযোগী, সীমান্ত বা ট্রানজিটে সহায়তা প্রদানকারী প্রভৃতি কাউকেই চিহ্নিত বা গ্রেপ্তার না করে যদি মাদক পাচারের মতো একটি সংঘবদ্ধ অপরাধের তদন্ত শেষ করা হয়; তা’হলে তা’ হবে একটি নিম্ন মানের তদন্ত। তাই, পণ্য প্রবাহ চিত্র, অর্থ প্রবাহ চিত্র, সম্পর্ক চিত্র, ঘটানপ্রবাহ চিত্র এবং মূল হোতার কর্মকৌশল চিত্র প্রভৃতি এনালাইটিক্যাল চার্ট তৈরির মাধ্যমে মূল হোতা ও তার সহযোগীদের চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হয়। এ কারণে, সংঘবদ্ধ অপরাধের তদন্তে এসব এনালাইটিক্যাল চার্টের ব্যবহার জানাটা জরুরী। অপরাধের তদন্তে, বিশেষ করে 'সংঘবদ্ধ অপরাধ'-এর তদন্তে, ক্রাইম প্রসিডস্ কিংবা অপরাধলদ্ধ আয় ট্র্যাক করে অপরাধচক্রের মূল হোতাকে চিহ্নিত করতে হয়। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে, অপরাধলব্ধ আয় বা সম্পত্তি বা সংশ্লিষ্ট ব্যাংক হিসাব জব্দ করতে হয়। বিশেষ করে , ২০১২ সালের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের মাধ্যমে অপরাধ চক্রের মূল হোতাদের আইনের আওতায় আনার কৌশল জানা তদন্তকারী ও তদারককারী কমকর্তাদের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
বিকাশ, নগদ, রকেট, ইউক্যাশ প্রভৃতি মোবাইল ফাইন্যান্সের মাধ্যমে এখন বিভিন্ন রকম অপরাধ হচ্ছে। যদিও এসব মাধ্যমে অর্থ লেনদেন বিশ্লেষণের উপর তদন্তকারী কর্মকর্তাদের খুব অল্প সংখ্যকেরই পেশাগত জ্ঞান রয়েছে। আবার ইন্টারনেটের মাধ্যমেও অপরাধ হচ্ছে। তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তার জন্য চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, ওয়েবসাইট থেকে বা ডিজিটাল ডিভাইস থেকে তিনি কিভাবে কি ধরণের সাক্ষ্য প্রমাণ বা তথ্য সংগ্রহ করবেন, যা কিনা একইসাথে আদালত- গ্রাহ্যও হবে।
জটিল মামলাসমূহের তদন্তে বা অপরাধসংক্রান্ত তথ্য উদঘাটনে সিডিআর বা কলরেকর্ড বিশ্লেষণ একটি অন্যতম কার্যকর 'টুল' হিসেবে বিবেচিত হয়। তদন্তকারী কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় কারিগরি জ্ঞান না থাকলে মামলার তদন্তে সিডিআর থেকে প্রয়োজনীয় সম্ভাব্য 'আউটপুট' তৈরি নাও হতে পারে। কোন দক্ষ নিয়মিত এনালিষ্ট দ্বারা বিশ্লেষিত হলে একই সিডিআর থেকে প্রয়োজনীয়/ অধিকতর তথ্য বা তথ্যসূত্র পাওয়া যায়, যা থেকে অপরাধ বা অপরাধীর রহস্য-উন্মোচনের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। আমরা হয়তো ৩০,০০০ (বাংলাদেশ পুলিশের এসআই থেকে তদুর্দ্ধ বিদ্যমান জনবল) তদন্ত বা তদারককারী পুলিশ কর্মকর্তাকে সিডিআর এনালিষ্ট বা ক্রিমিনাল ইন্টিলিজেন্স এনালিস্ট বানাতে পারব না; কিন্তু পুলিশ আদেশ ১/২০২৪ অনুসরণ করে প্রতি জেলা বা ইউনিটে একটি ছোট্ট জনবলকে প্রশিক্ষিত করে ক্রিমিনাল ইন্টিলিজেন্স এনালাইসিস সেলের মাধ্যমে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের তদন্তে সহায়তার জন্য নিযুক্ত করতে পারি। আনুষ্ঠানিকভাবে 'ক্রিমিনাল ইন্টিলিজেন্স এনালাইসিস সেল' প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত এ সহায়তার ক্ষেত্রটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে থাকেনা; বরং অপরাধ গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণ অনেকটাই ব্যক্তি বা কর্মকর্তাবিশেষ নির্ভর রয়ে যায়। সহায়তার ক্ষেত্রটি প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামোতে এনে আমরা প্রায় ১০০% মামলার তদন্তের ফলাফলে বিষ্ময়কর ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারি।
কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে জেলার ক্রিমিনাল ইন্টিলিজেন্স এনালাইসিস সেলের ভূমিকা ব্যাখ্যা করা যায়। জনৈক জয়নাল উদ্দিনকে ৩০০ পিস ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করা হল। জেলার ক্রিমিনাল ইন্টিলিজেন্স সেলের রেকর্ড অনুযায়ী জয়নাল উদ্দিন ইয়াবা ডিলার বিশ্বজিত সাহার হয়ে কাজ করে। ক্রিমিনাল ইন্টিলিজেন্স সেলের নির্দেশনানুযায়ী বিশ্বজিত সাহাকে গ্রেপ্তার করা হয়, যদিও বিশ্বজিত সাহার কাছ থেকে ২টি সিমযুক্ত ১টি মোবাইল ফোন ছাড়া আর কিছু্ই উদ্ধার করা হয় না। কিন্তু ক্রিমিনাল ইন্টিলিজেন্স সেল বিশ্বজিত সাহার মোবাইল বিকাশ হিসাবের বিবরণী সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে পূর্বোক্ত জয়নাল উদ্দিনসহ স্থানীয় মাদক চক্রের মুখ্য আয়ভোগী হিসাবে তার ভূমিকা ও যোগাযোগের প্রমাণ পান এবং পরবর্তীতে মাদক ডিলার বিশ্বজিত সাহার মাদক ব্যবসায় অর্জিত সম্পদ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করে সিআইডি’র মাধ্যমে মানি লন্ডারিং মামলা রুজু করিয়ে তার সকল ক্রাইম প্রসিড্স বাজেয়াপ্তের ব্যবস্থা করেন। মাদক ব্যবসায়ী বিশ্বজিত সাহার এ হাল জনমনে পুলিশের মাদক-বিরোধী ভূমিকা সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করে।
নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁওএলাকায় এক অজ্ঞাতনামা কিশোরীর লাশ পাওয়া গেল। ক্রিমিনাল ইন্টেলিজেন্স এনলাইসিসে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জেলা পুলিশের অতিঃ পলিশ সুপার পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা ক্রাইমসিনকে ঘিরে কয়েকশ’ মিটার এলাকা সার্চ করতে বললেন। ঘটনার একদিন পরে ঘটনাস্থল থেকে ১০০ মিটার দূরে সিমবিহীন মোবাইল ফোন খুঁজে পেয়ে জব্দ করা হল। এ মোবাইল ফোনের সিডিআর বিশ্লেষণ করে ভিকটিমের পরিবার ও তার পরিচয়কে সনাক্ত করা হয়। মোবাইল ফোনটি মূলত ভিকটিমের মা নিয়মিত ব্যবহার করতেন বলে জানা যায়। ভিকটিম নিজে কখনও কখনও ইমো বা হোয়াটস্-অ্যাপের মাধ্যমে তার কথিত বয়ফ্রেন্ডের সাথে যোগাযোগ রাখতেন। এখন ডিজিটাল ফরেনসিক বিশেষজ্ঞের সহায়তা নিয়ে সম্ভাব্য খুনীকে চিহ্নিত করার কাজটি চলছে।
আবার ধরা যাক, বিকাশের এজেন্ট খাইরুলের কাছে জনৈক কাস্টমার বশির উদ্দিন ৫০,০০০ টাকা ক্যাশ-আউট করে চলে গেলেন। এজেন্ট খাইরুল একটু পর দেখতে পান, তার এজেন্ট হিসাবের মোবাইল সিম কাজ করছে না। কয়েক ঘন্টা পর নতুন সিম তুলে তিনি দেখেন, তার এজেন্ট হিসাবের ৩ লক্ষ টাকার পুরোটাই চুরি হয়ে গেছে। এখানে চোর কে, চোর চক্র কি কৌশলে ৩ লক্ষ টাকা চুরি করলো আর চুরির সাথে কাস্টমার বশির উদ্দিন বা তার ৫০,০০০ টাকার কি সম্পর্ক আছে, এসব বের করার জন্য জেলা পর্যায়ে একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ক্রিমিনাল এনালিস্ট বা তার দল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
সিআইডি’র ফরেনসিক ট্রেনিং ইন্সটিটিউট (এফটিআই) ২০১৩ সাল থেকে 'ক্রিমিনাল ইন্টেলিজেন্স এনালাইসিস কোর্স (সিআইএসি)' পরিচালনা করে আসছে। এই কোর্স, যা 'সিডিআর এনালাইসিস কোর্স' নামেও পরিচিত, বাংলাদেশে পুলিশ অফিসারদের মধ্যে লক্ষ্যনীয় জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এ যাবত ১০০০-এরও বেশি অতিঃ এসপি ও এএসপি-কে এবং ১০০-এর বেশি অন্যান্য কর্মকর্তাকে ক্রিমিনাল ইন্টিলিজেন্স এনালাইসিসের উপর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। যাই হোক, ক্রিমিনাল ইন্টেলিজেন্স চালিত বাংলাদেশ পুলিশের সাফল্যকে দেখতে হলে প্রতিটি জেলা বা ইউনিটে প্রাথমিকভাবে ৩০-১০০ জনবলের একটি ক্রিমিনাল ইন্টেলিজেন্স এনালাইসিস ইউনিট থাকতে হবে, যার সদস্যরা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নিয়ে মাঠ পর্যায়ে প্রতিনিয়ত তদন্তকারী কর্মকর্তাদের তদন্তে সহায়তা করবেন। বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই পুলিশকে ইন্টেলিজেন্স এনালাইসিসে সহায়তা প্রদানের জন্য পৃথক এনালিস্ট রয়েছে।
অবশ্য ক্রিমিনাল-ইন্টেলিজেন্স-চালিত পুলিশিং-এর সাফল্যের জন্য এ ক্রিমিনাল-ইন্টেলিজেন্স এনালাইসিস ইউনিট বা সি.আই.এ.ইউ. যাদের প্রত্যক্ষ সেবা দিবে – মাঠ পর্যায়ের তদন্তকারী বা তদারককারী কর্মকর্তা – তাদেরও কিন্তু ক্রিমিনাল-ইন্টেলিজেন্স বিষয়ে ওয়ার্কিং নলেজ থাকতে হবে। তার মানে কি দাঁড়াচ্ছে? বাংলাদেশ পুলিশের এসআই থেকে অতিঃ এসপি পর্যন্ত প্রায় ৩০ হাজার কর্মকর্তাকে দ্রুততম সময়ে বিজ্ঞানভিত্তিক তদন্তের ওয়ার্কিং নলেজ প্রদান নিশ্চিত করতে হবে।
বিজ্ঞানভিত্তিক তদন্তের সংজ্ঞাটি কি হবে? মৌখিক সাক্ষ্য নির্ভর তদন্ত বাদ দিয়ে বস্তগত সাক্ষ্য-নির্ভর তদন্ত? না। না, এই অর্থে যে, এমনকি সাক্ষী বা আসামীকে জিজ্ঞাসাবাদ কৌশলেও বিজ্ঞানভিত্তিক প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। আপনি কি স্বীকার করবেন যে, সোয়া দু’ লক্ষ পুলিশ বাহিনীর ৩০ সহস্রাধিক এসআই ও তদুর্ধ কর্মকর্তার মধ্যে অনেক কর্মকর্তাকেই জিজ্ঞাসাবাদ কৌশলের উপর প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ দেয়ার প্রয়োজনীয়ত রয়েছে। যদিও প্রথাগত পুলিশী তদন্তে আমাদের কার্যবিধি ১৬১ ধারায় সাক্ষী বা আসামীর জবানবন্দি লিপিবদ্ধকরণ নির্ভরতাই বেশি ।
যাই হোক, আমরা বলছিলাম, বিজ্ঞানভিত্তিক তদন্তকে আমরা কিভাবে সংজ্ঞায়িত করব? tutelagebd.com-এর মাধ্যমে বিজ্ঞানভিত্তিক তদন্তের জন্য যে সব বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়, তার মধ্যে অন্যতম কয়েকটির তালিকা দেখতে এখানে ক্লিক করুন।
এসব বিভিন্নমুখি চ্যালেঞ্জ, যা একুশ শতাব্দীর নাগরিককে সেবাপ্রদানকারী একজন তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তাকে মোকাবেলা করতে হবে বা হচ্ছে, সেসব বিবেচনায় রেখে tutelagebd.com-এর বিভিন্ন কোর্সসমূহের বিষয়বস্তু সাজানো হয়েছে। সিআইডির ফার্মসিক ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে ২০১২ সাল থেকে পরবর্তী ৮ বছরে ১৫ হাজারেরও পুলিশ কর্মকর্তাকে বিজ্ঞানভিত্তিক তদন্তের উপর প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। পুলিশের পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশন, জুডিশিয়াল ক্যাডার ও মাদক দ্রব্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। বিশেষ ৬টি ব্যাচে দুর্নীতি দমন কমিশনের ১৫০ জন কর্মকর্তার জন্য ‘ফাইন্যান্সিয়েল ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন’ কোর্স করানো হয়েছে।
এফটিআই-এর মুখ্য টপিকসমূহ যথা- সিডিআর বিশ্লেষণ, সেলআইডি ট্র্যাকিং, অপ্রদর্শিত বা কালো টাকা বিশ্লেষণপূর্বক মানি লন্ডারিং আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ, মোবাইল ফাইন্যান্স সংশ্লিষ্ট অপরাধের তদন্ত, ক্রাইম ডেটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম বা সিডিএমএস-এর ব্যবহার, ক্রাইম সিন ম্যানেজমেন্ট, আইটি ফরেনসিক ও সাইবার ক্রাইম, ডিএনএ আলামত সংগ্রহ কৌশল, ভিজ্যুয়াল এনালাইটিক্যাল চার্টের মাধ্যমে সংঘবদ্ধ অপরাধের তদন্ত , কিংবা নারী, শিশু, ভিকটিম ও সন্দিগ্ধ ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ কৌশল বিষয়ে প্রশিক্ষণ সারা দেশের তদন্ত ও তদারককারী কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি করেছে।
কিন্তু আমাদের সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, আমাদের ৩০টিরও বেশি বিষয় নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে, তবে কোন একটি বিষয়ে বছরে ১ বা ২ হাজারের বেশি পুলিশকে প্রশিক্ষণ দিতে পারছি না। যাই হোক, বিজ্ঞানভিত্তিক তদন্তে কেবল একটি বিষয়ে আমরা বছরে ১ হাজার পুলিশকে প্রশিক্ষণ দিতে পারলেও কেবল এসআই থেকে তদুর্ধ্ব পদমর্যাদার ৩০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ দিতে আমাদের লাগবে ৩০ বছর!
এই বাস্তবতায় আমাদের দুটো অপশন রয়েছে।
এক, আমরা প্রতিটি জেলা থেকে ১ বা ২ জন করে অতিঃ এসপি/এএসপি ও ২/৩ জন পরিদর্শক ও এসআই-কে নিয়ে প্রায় ৩০০ কর্মকর্তাকে ToT বা প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণ কোর্স করিয়ে তাদের দিয়ে নিজ নিজ জেলা বা ইউনিটে প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করতে পারি।
দুই, tutelagebd.com-এর মাধ্যমে একই সাথে বহু সংখ্যক পুলিশ কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে অনলাইনে প্রশিক্ষণ গ্রহণের ব্যবস্থা করিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক তদন্তের জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে পারি। একটি নমুনা প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের নিমিত্তে নিবন্ধনের জন্য এখানে ক্লিক করুন।
বিষয়ভিত্তিক প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রি-টট ও টট কোর্সের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিটি থানা ও জেলায় এবং তার ধারাবাহিকতায় দেড় থেকে দু’ বছরেই পুলিশের সংখ্যা-গরিষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ অংশের মধ্যে বিজ্ঞানভিত্তিক তদন্তের মূল সূত্র পৌঁছে দিতে পারি। তবে, এখানে জেলা বা রেঞ্জ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব হচ্ছে, উপযুক্ত কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ করিয়ে নিয়ে তাদের দিয়ে নিজ নিজ জেলায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রশিক্ষণের আয়োজন করা; এবং প্রশিক্ষণ শেষে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কাছ থেকে মান-উন্নীত সেবা আদায় নিশ্চিত করা।
মাঠ পর্যায়ে বিজ্ঞানভিত্তিক তদন্তে সক্ষম কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের গাইড করা কিংবা তাদের পরিশ্রমলব্ধ তদন্তকে সমর্থন বা উৎসাহ যোগানো, কিংবা নীতিগত বা বস্তুগত সমর্থন দেওয়ার মতো সচেতনতা ও দায়বোধ নিয়ে মধ্য বা উর্ধ্ব-পর্যায়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ আছেন, এমন বাস্তবতা তৈরি করতে পারলে বিজ্ঞানভিত্তিক তদন্তে পুলিশের সামগ্রিক আউটপুট লক্ষ্যনীয় পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।